আজ শুভ মধু পূর্ণিমা। বৌদ্ধ বিশ্বের জন্য এটি অত্যন্ত আনন্দঘন একটি তিথি এবং এর আবেদন অত্যন্ত তাৎপর্যময়।
মধু পূর্ণিমাকে ঘিরে রয়েছে বুদ্ধের জীবনের ঐতিহাসিক ঘঠনাপ্রবাহ । বিশেষ করে এদিনটি ত্যাগ ও ঐক্যের মহিমায় সমুজ্জল । ভাদ্র মাসের পূর্ণিমা তিথিকে বলা হয় মধু পূর্ণিমা।
বৌদ্ধরা কেন মধু পূর্ণিমাকে অতি শ্রদ্ধার সাথে পালন করে থাকেন? এর তাৎপর্য ব্যাখা করতে গেলে দুটো দিক পরিলক্ষিত হয়। একটি হচেছ সেবা ও ত্যাগের , অন্যটি হচেছ সৌর্হাদ্য, সম্প্রীতি ও সংহতির ।
ত্যাগের মহিমা হলো পারিলেয্য বনের বানর কর্তৃক ভগবান বুদ্ধকে মধু দান ও হস্তিরাজ কর্তৃক সেবা প্রদান । আর সৌর্হাদ্য ও সংহতি হলো কৌশম্বীর ঘোষিতারামে বিবদমান ভিক্ষু সংঘের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা ।
মধু পূর্ণিমার ঘটনায় বলা যায়, এক সময় ভগবান বুদ্ধ দশম বর্ষাব্রত পারিলেয়্য রক্ষিত বনে অধিষ্ঠান করেছিলেন। কৌশাম্বীর ঘোষিতা রামের দু’জন পণ্ডিত ভিক্ষুদের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি বিনয় বিধান নিয়ে ভিক্ষুসংঘ দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়লে তথাগত বুদ্ধ একক বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়ে পারিলেয়্য বনে বর্ষাবাস অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন।
সেদিন বুদ্ধ বুঝতে পেরেছিলেন, অজ্ঞানীদের সঙ্গে বসবাস সুখকর নয় এবং বংশমর্যাদা মানুষকে হীন স্তরে নিয়ে যায়।
বুদ্ধ ভিক্ষুদের আহ্বান করে কলহ-বিবাদ করা অনুচিত বলে বোঝাতে চেষ্টা করেন। রাগের বশবর্তী হয়ে কোনো বিষয়ে অনঢ় থাকা উচিত নয় বলে তিনি সকলকে জানান। এই উপদেশ প্রদানকালে বুদ্ধ তাদের দীর্ঘায়ু কুমারের কাহিনী বলেন।
সে কাহিনীতে উল্লেখ আছে যে, কলহ ও রাগের প্রভাব জন্ম-জন্মান্তর প্রবাহিত হয়। কিন্তু এতে উভয়ের ক্ষতি ছাড়া কোনো মঙ্গল হয়না। এমনকি শুধু কলহজনিত রাগের কারণে কোনো ভালো কাজও উপযুক্ত সময়ে করা যায়না।
তাই সবসময় কলহ-বিবাদ পরিত্যাগ করা উচিত। বুদ্ধের নানাবিধ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও কৌশাম্বীবাসী ভিক্ষুরা কলহ থেকে বিরত হলেন না। নিজেদের মধ্যে কলহ ত্যাগ করে প্রীতির সম্পর্ক তৈরী করতে পারলেন না।
তখন বুদ্ধ কৌশাম্বীবাসী ভিক্ষুদের সংসর্গ ত্যাগ করে নিজে একাকী নির্জন গহীন বনে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। একসময় তিনি চলে গেলেন পারিল্যেয় নামক বনে। ভিক্ষুদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে তিনি সেখানে স্বাচ্ছন্দে অবস্থান করতে লাগলেন।
বুদ্ধ বনের মধ্যে একটি ভদ্রশাল গাছের নিছে আশ্রয় নেন। সেখানে অবস্থান করছিল একটি হাতি। হাতিটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজের শুঁড় দিয়ে বুদ্ধের বসবাসের জায়গাটি পরিস্কার করে দেয়। হাতিটি বুদ্ধের জন্য নিয়মিত পানীয় জলও সংগ্রহ করে আনত।
সেবাদানের জন্য সর্বদা তৎপর থাকতো। এভাবে হাতিটি নিজের ইচ্ছাতেই বুদ্ধের সেবাই নিয়োজিত থাকতো।
এমনকি হিংস্র প্রাণীর উৎপাত ও আক্রমণ থেকে বুদ্ধকে রক্ষা করত, পাহারা দিত। ভগবান বুদ্ধ প্রাণীদের প্রতি অসীম ও অপ্রমেয় মৈত্রী প্রভাবে নিরাপদে ওই বনে বসবাস করতে পেরেছিলেন। বনে অন্যান্য পশু-পাখিও বুদ্ধকে নানাভাবে সেবা-যত্ন করত।
বুদ্ধের মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা বলে এটি সম্ভব হয়েছিল। মৈত্রীগুণে প্রাণীরা নত হয়, প্রভুভক্ত হয়। বোধিস্বত্ব ও বুদ্ধজীবনেই এটি একমাত্র সম্ভব; সাধারণ জীবনে নয়।
কারণ আমাদের চিত্ত প্রতি মুহূর্তে হিংসা-বিদ্বেষে এবং ক্রোধ ও মোহাগ্নিতে জ্বলছে, নানা পাপ-পঙ্কিলতায় চিত্ত পরিপূর্ণ রয়েছে। ওই চিত্তে কখনও ধ্যান-সমাধি হয় না এবং প্রাণীদের মৈত্রীদান করা ও বশীভূত করাও সম্ভব নয়। কারণ হিংসা দিয়ে হিংসাকে কখনও প্রশমিত করা যায় না, অহিংসা বা অবৈরিতা দিয়েই হিংসাকে প্রশমিত করতে হয়। এটাই জগতের নিয়ম। পারিলেয়্য বনে বুদ্ধ সেটাই প্রমাণ করেছিলেন।
বন্যপ্রাণী হাতির এরূপ সেবাপরায়ণতা দেখে বনের এক বানরও বুদ্ধকে সেবা করতে আগ্রহী হয়। সে চেতনায় বানরটি অত্যন্ত শ্রদ্ধা সহকারে বন থেকে মধু সংগ্রহ করে বুদ্ধকে দান করে। বুদ্ধ বানরের দেওয়া মধু সন্তষ্ট চিত্তে গ্রহণ করেন। এতে বানর খুবই প্রীত হয়। মনের সুখে এক বৃক্ষ থেকে অন্য বৃক্ষে লাফাতে থাকে। বানরটি আনন্দে আত্মহারা হয়ে লাফানোর সময় হঠাৎ মাটিতে পড়ে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বুদ্ধ দিব্যচক্ষুতে দেখলেন যে, মধুদানের ফলে বানর মৃত্যুর পর দেবলোকে পূনর্জন্ম গ্রহণ করেছে। এই ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল ভাদ্র পূর্ণিমা তিথিতে। এই অনন্য ঘটনাকে স্মরণ করে বৌদ্ধরা এই পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষু সংঘকে মধুদান করেন। এইসব কারনে ভাদ্র পূর্ণিমাকে মধু পূর্ণিমা বলা হয়ে থাকে।
এদিকে বৌদ্ধ উপাসক উপাসিকাগণ কৌশম্বীর ঘোষিতারামে গিয়ে দেখলেন ভগবান বুদ্ধ বিহারে নেই ।
বুদ্ধের অনুপস্থিতিতে কৌশাম্বীর আকাশে বাতাসে করুণ মূর্ছনা ও নিস্তব্ধতা দেখা দিল । উপাসক উপাসিকা সবাই জানতে চাইল ভগবান বুদ্ধ কোথায় ?
কোন উত্তর নেই বিবদমান ভিক্ষুগণের মধ্যে । ভিক্ষু সংঘের মধ্যে নিরবতা , নিশ্চল-নিশ্চুপ দেখে উপাসক উপাসিকাদের মধ্যে প্রকাশ পেল যে, ভিক্ষু সংঘের বিরোধ ও বিবাদের কারণে বুদ্ধ ঘোষিতারাম ছেড়ে পারিলেয্য বনে চলে গেলেন । ভিক্ষু সংঘের অবিদ্যা ও অহমিকা দেখে ভগবান বুদ্ধ একলা চলো নীতি গ্রহণ করলেন ।
এর মধ্যে উপাসক উপাসিকারা ভিক্ষু সংঘের প্রতি বীতশ্রদ্ধা জানাতে শুরু করলেন । তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যদি ভগবান বুদ্ধ কৌশাম্বীর পুণ্যধামে ফিরে না আসে তাহলে সংঘ সান্নিধ্য পরিত্যাগ করবেন ।
উপাসক উপাসিকাদের কারণে ভিক্ষু সংঘের মধ্যে সম্যক চেতনার উন্মেষ হলো । তারা বুঝতে পারলেন তাদের ভুলের কথা । তাদের মধ্যে সম্প্রীতির রেখা জাগ্রত হলো ।
বৌদ্ধরা এই পূর্ণিমাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকেন। এই দিন বৌদ্ধরা উপোসথ শীল পালন করে থাকে। বালক-বালিকা, নর-নারী, শিশু-কিশোর সকলেই মধু ও অন্যান্য দানীয় সামগ্রী নিয়ে বিহারে গিয়ে বুদ্ধ পুজা, সীবলি পুজা, শীল গ্রহণ, সংঘদান, মধু ও ভেষজ দান, মোমবাতি প্রজ্জ্বলন, ভিক্ষুসংঘকে পিণ্ডদানসহ নানা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন।।
দান, সেবা ও পুজার নিদর্শন হিসেবে এই পূর্ণিমার গুরুত্ব বৌদ্ধ ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে।
চট্টগ্রামের বৌদ্ধ তারুণ্য সংঘটন “সম্যক” চট্টগ্রাম মহানগর, রাউজান শাখা, রাঙ্গুনিয়া শাখার সদস্যরা মিলে মধু পূর্ণিমা পালন করে থাকে।
বিহারে গিয়ে সমবেত প্রাথনার মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি কামনায় পূর্ণদান করে থাকে। আজ শুভ মধু পূর্ণিমা আমাদের সেই মহৎ শিক্ষাই দিচ্ছে। আমরা যেন আমাদের মানবীয় গুণাবলিতে পুনরুজ্জীবিত-সিক্ত হই এবং দানে, ত্যাগে ও পরোপকারে বিশ্ব মানবতায় এগিয়ে যাই।